শেয়ারবাজারে ব্যতিক্রমী নজির স্থাপন করলেন স্কয়ার ফার্মার চার উদ্যোক্তা পরিচালক। সাম্প্রতিক দরপতনে শেয়ারের দাম অস্বাভাবিকভাবে কমে যাওয়ায় কোম্পানিটির চার পরিচালক মিলে দৈনন্দিন লেনদেনের (সেকেন্ডারি) বাজার থেকে ১২ লাখ শেয়ার কেনার ঘোষণা দিয়েছেন। বর্তমান বাজারমূল্যে যার দাম ২২ কোটি টাকার বেশি। তাতে ব্যক্তিগতভাবে চার উদ্যোক্তার প্রত্যেকে বিনিয়োগ করবেন ৫ কোটি টাকার বেশি।
দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্য অনুযায়ী, স্কয়ার ফার্মার যে চার উদ্যোক্তা বাজারমূল্যে শেয়ার কেনার ঘোষণা দিয়েছেন, তাঁরা হলেন কোম্পানিটির চেয়ারম্যান স্যামুয়েল এস চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান রত্না পাত্র, ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন চৌধুরী ও পরিচালক অঞ্জন চৌধুরী। সম্পর্কে তাঁরা ভাই-বোন এবং প্রয়াত শিল্পোদ্যোক্তা স্যামসন এইচ চৌধুরীর ছেলে-মেয়ে। গত বৃহস্পতিবার ও গতকাল মঙ্গলবার কোম্পানিটির এ চার উদ্যোক্তা আলাদাভাবে ৩ লাখ করে মোট ১২ লাখ শেয়ার কেনার ঘোষণা দেন, যা কোম্পানিটির মোট শেয়ারের প্রায় দেড় শতাংশ।
গত বৃহস্পতিবার প্রথম দুই উদ্যোক্তার শেয়ার কেনার ঘোষণা আসার পর ঢাকার বাজারে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম বেড়েছে ৩০ টাকার বেশি। বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, স্কয়ারের উদ্যোক্তাদের এ ঘোষণা কোম্পানিটির শেয়ারের অস্বাভাবিক দরপতন রোধের পাশাপাশি বাজারে আস্থা ফেরাতে বড় ভূমিকা রেখেছে। তাই এ উদ্যোগকে তাঁরা অনন্য নজির হিসেবে অভিহিত করছেন।
জানতে চাইলে ডিএসইর পরিচালক মিনহাজ মান্নান বলেন, ‘শেয়ারবাজারের একজন অংশীজন হিসেবে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, স্কয়ার ফার্মার শেয়ার কিনে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এমন নজির খুবই কম। বেশির ভাগ কোম্পানির উদ্যোক্তারা যেখানে নানা ধরনের কারসাজি ও অনিয়মের মাধ্যমে নিজেদের বিত্তবৈভব বাড়িয়েছেন, সেখানে বরাবরই ব্যতিক্রম নজির রেখে চলেছে স্কয়ার। শেয়ারবাজারের সব ধরনের অনুশাসন পরিপালনের ক্ষেত্রেও কোম্পানিটি বরাবরই শ্রদ্ধাশীল। বাজারে এ রকম কোম্পানির সংখ্যা আরও বেশি থাকলে আমাদের শেয়ারবাজারের বর্তমান চেহারা দেখতে হতো না।’
স্কয়ার ফার্মার চার পরিচালক যখন দরপতন ঠেকাতে নিজেরা বিনিয়োগে এগিয়ে এলেন, তখন বাজারে তালিকাভুক্ত অনেক শেয়ারের দাম অভিহিত মূল্যের নিচে নেমে গেছে। বর্তমানে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মধ্যে ৫৩টির দাম অভিহিত মূল্যের নিচে রয়েছে। এর মধ্যে সম্প্রতি তালিকাভুক্ত হওয়া বস্ত্র খাতের কোম্পানি রিংসাইন টেক্সটাইল তালিকাভুক্তির এক মাস না যেতেই ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের নিচে নেমে এসেছে। শেয়ারের দাম অভিহিত মূল্যের নিচে নেমে এলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোর উদ্যোক্তারা শেয়ার কেনায় এগিয়ে আসেন না। এ কারণে দীর্ঘদিন ধরে বাজারের সাধারণ বিনিয়োগকারীরা পুনঃক্রয় বা বাইব্যাক আইনের দাবি জানিয়ে আসছেন। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরনের আইন করার কোনো উদ্যোগ এখন পর্যন্ত নেওয়া হয়নি।
বিনিয়োগকারীরা বলছেন, বাইব্যাক আইন থাকলে তাতে তালিকাভুক্ত কোনো কোম্পানির শেয়ারের দাম ইস্যু মূল্যের নিচে নেমে গেলে উদ্যোক্তারা বাজার থেকে ওই কোম্পানির শেয়ার কিনতে বাধ্য হতেন। অন্যদিকে, শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির উদ্যোক্তা-পরিচালকদের জন্য ন্যূনতম শেয়ার ধারণের আইন থাকলেও অনেক তালিকাভুক্ত কোম্পানির উদ্যোক্তা-পরিচালকেরা তা পরিপালন করছেন না। বিএসইসির পক্ষ থেকে সেসব কোম্পানির উদ্যোক্তা-পরিচালকদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে না।
বিএসইসির আইন অনুযায়ী, তালিকাভুক্ত কোম্পানির উদ্যোক্তা-পরিচালকদের হাতে সম্মিলিতভাবে সব সময় ওই কোম্পানির ৩০ শতাংশ শেয়ার থাকা বাধ্যতামূলক। আর পরিচালকদের হাতে এককভাবে ওই কোম্পানির ২ শতাংশ শেয়ার থাকার আইনি বিধান রয়েছে। আইনটি করা হয়েছে ২০১১ সালে। ওই আইন করার পর ২০১৩ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয় বস্ত্র খাতের কোম্পানি ফ্যামিলিটেক্স এবং ২০১৫ সালে বাজারে আসে সিঅ্যান্ডএ টেক্সটাইল। ডিএসইর তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে কোম্পানি দুটির উদ্যোক্তা-পরিচালকদের হাতে সম্মিলিতভাবে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির ৩০ শতাংশের কম শেয়ার রয়েছে। অর্থাৎ আইন থাকার পরও কোম্পানি দুটির উদ্যোক্তারা তাঁদের হাতে থাকা বেশির ভাগ শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন। কীভাবে এটি সম্ভব হলো, এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাচ্ছেন না বিনিয়োগকারীরা।
এই যখন শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত অনেক কোম্পানির উদ্যোক্তাদের আচরণ, তখন স্কয়ার ফার্মার চার উদ্যোক্তার ব্যতিক্রমী পদক্ষেপের অংশ হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠানের শেয়ার কেনার ঘোষণা দিয়েছেন। কেননা টানা দরপতনে স্কয়ার ফার্মার শেয়ারের দাম অস্বাভাবিকভাবে কমে নেমে এসেছিল ২০০ টাকার নিচে।
জানতে চাইলে স্কয়ার ফার্মার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাজারের অব্যাহত পতনে আমাদের কোম্পানির দাম যখন অস্বাভাবিকভাবে কমে যাচ্ছিল, তখন আমরা আমাদের দায়িত্ববোধ থেকে শেয়ার কেনার ঘোষণা দিয়েছি। কারণ, দাম যে পর্যায়ে নেমে এসেছে, সেখানে নামার যৌক্তিক কোনো কারণ নেই। কোম্পানির ব্যবসার প্রবৃদ্ধি, মুনাফা, লভ্যাংশ—সবই ভালো। তারপরও এমনভাবে দাম কমার কোনো কারণ আমরা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তাই সাধারণ বিনিয়োগকারীরা যাতে আমাদের শেয়ার কিনে লোকসানে না পড়েন এবং স্কয়ারের শেয়ারের ওপর তাঁদের আস্থায় কোনোভাবেই ঘাটতি যাতে দেখা না দেয়, সে জন্য আমরা বাজার থেকে শেয়ার কেনার উদ্যোগ নিই। আমাদের শেয়ার কেনার ঘোষণার পর তার ইতিবাচক প্রভাব দামে পড়েছে। সার্বিকভাবে বাজারও তাতে উপকৃত হয়েছে।’
তপন চৌধুরী আরও বলেন, বাজারে মৌলভিত্তির যেসব কোম্পানি রয়েছে, সেগুলোর শেয়ার কিনে যাতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত না হন, তার জন্য সেসব কোম্পানির উদ্যোক্তাদেরও এগিয়ে আসা উচিত। কারণ, সাধারণ বিনিয়োগকারীদের প্রতি কোম্পানির উদ্যোক্তাদেরও একধরনের দায়িত্ববোধ রয়েছে।